নাহিদ! এই যে তুই তোর স্ত্রীকে কয়দিন পরপরই মারামারি করিস, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করিস, তাকে তার বাপের বাড়ি থেকে এটা সেটা আনতে বলিস- এগুলো কি ঠিক হচ্ছে, বন্ধু? তোর বাসায় গেলেই তো তোকে সবসময় দেখতে পাই তুই তোর স্ত্রীর সাথে রাগারাগি করে কথা বলছিস। অনেক সময় তুই নিজেও আমাকে বলিস যে, স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে তোকে কিছু দেয়-টেয় না। আর এভাবে তোর স্ত্রী এবং শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি যুলুম করা একদমই কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, বন্ধু।
কেনো? আমি কি কোনো দোষ করেছি নাকি?
আরে কী বলিস এসব? দোষ করেছিস না মানে? তোর কাছে কি এগুলো দোষ মনে হয় না? নাকি দোষকে দোষ হিসেবে বোঝার ক্ষমতাটুকু তুই হারিয়ে ফেলছিস?
না, তা হবে কেনো?
আচ্ছা,এবার তোকে একটি কথা জিজ্ঞেস করি।
কী জিজ্ঞেস করবি, কর?
মনে কর, কেউ একটি জিনিস তৈরী করে তা বছরের পর বছর লালন পালন করে তাদের প্রিয় জিনিসে পরিণত করে তুললো। আর একসময় তাদের সেই প্রিয় জিনিসটিকে নিজেরা ভোগ না করে তোকে এনে দিয়ে দিলো তবে সে জিনিসটির প্রতি এবং যারা এর পেছনে এতো এতো কষ্ট করেছেন তাদের প্রতি তোর কেমন আচরণ হবে?
হঠাৎ এমন আজগুবি প্রশ্ন কেনো? কেউ আমাকে কেনোই-বা তার প্রিয় জিনিসটি দিতে যাবে?
আহহা, কেনো দিতে যাবে তা পরে দেখা যাবে। আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দেস না।
অবশ্যই আমি সেটাকে খুব যত্ন করে রাখবো। আমার কাছে সেটার গুরুত্বও অন্যরকম থাকবে। অপরদিকে, যারা দিলেন তাদের প্রতি তো আমি রীতিমতো ঋণী হয়ে থাকবো। কেননা তারা তাদের প্রিয় জিনিসটি নিজে ভোগ না করেই তো আমাকে দিয়ে দিলেন। ফলে নিঃসন্দেহে আমার নিকট তাদের সম্মান আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে।
কিন্তু কেনো?
আরে বাহ্, এটা কোনো কথা হলো! একজন মানুষ আমাকে একটি জিনিস এতো বছর লালন- পালন করে দিয়ে দিবে আর আমি তাদের দেওয়া সে পরম জিনিসটিকে যত্ন করে রাখবো না কিংবা গুরত্ব দেবো না তা কী করে হয়? তাছাড়া, যারা দিলেন তারা তো নিশ্চয়ই অনেক সম্মানের দাবিদার, সর্বোপরি কৃতজ্ঞতা পাওয়ার দাবিদার।
তুই কি কথাগুলো সত্যি সত্যি বলছিস?
আরে ব্যাটা, তুই এতোকিছু বুঝিস আর এই সহজ বিষয়টিতে তোর না বোঝার কী আছে?
বাহ্ তাহলে তো দেখছি, তুই অনেক ভালোই বুঝিস। যাইহোক, এবার তাহলে আমরা সেই প্রশ্নে ফিরে যাই যেই প্রশ্ন তোর কাছে আজগুবি মনে হয়েছিলো।
দেখ, নাহিদ! কেউ যদি একটি জিনিস তৈরী করে বছরের পর বছর লালন পালন করে তোকে এনে সেটা দিয়ে দেয়। আর সেটা যদি তোর মতে অধিক যত্ন ও গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে তবে যে মা-বাবা তাদের মেয়েকে জন্ম দিয়ে বছরের পর বছর লালন পালন করে সেই মেয়ের কাছ থেকে নিজেরা কোনো সেবা গ্রহণ না করে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে তোর প্রয়োজনীয় সকল সার্ভিস গ্রহণ করার সুযোগ করে দিলেন সেই মেয়ে কি তার স্বামীর নিকট অধিক যত্ন ও গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে না?সেই মেয়ের বাবা মা কি তাদের আদরের কন্যার জামাইয়ের কাছে সম্মান পাওয়ার দাবি রাখেন না? যেই মেয়ে তার বাবা মার ঘরে রাণীর মতো ট্রিট পেতো সেই মেয়ে কি তার স্বামীর ঘরে এসে সামান্য ভালো ব্যবহারটুকু-ই পাবে না?
তা তো অবশ্যই।ওহ,এখন তাহলে বুঝতে পারছি আমাকে দিয়ে এতোকিছু বলানোর মানে কী ছিল।
হুম, তা তো বুঝবেই! তাহলে তুই কিভাবে তাদের মেয়ের মাধ্যমে তাদের কাছে ইফতারী, আম-কাঠাঁল, ঈদের শপিং,কুরবানীর ঈদ ইত্যাদির নামে সময়ে সময়ে এটা সেটা চাইতে পারিস? এই কি তাদের প্রতি তোর সম্মানের নমুনা? এই কি ঋণী হয়ে থাকার হালত? ভদ্রবেশে যৌতুক চেয়ে তাদেরকে মানসিক ও আর্থিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখাটাই কি তাদের প্রতি তোর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নমুনা?
একজন মা-বাবা সারাজীবন কষ্ট করে তাদের মেয়ের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে খাইয়ে বড়ো করে তুললেন, বড়ো হয়ে উঠার পথে চিকিৎসা বাবদ যতো খরচ করতে হয়েছে তার যাবতীয় খরচ বহন করলেন, পড়াশোনা করিয়ে শিক্ষিত করে তুললেন। অতঃপর তাদের আদরের মেয়েটিকে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। অথচ সেই আদরের মেয়ের পিছনে এতো কিছু ইনভেস্ট করেও তারা নিজেরা তার থেকে কোনো সার্ভিস গ্রহণ না করে জলজ্যান্ত একজন মানুষকে তার স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তারপর তার স্বামী সেই মেয়ের কাছ থেকে তার বাচ্চা-কাচ্চা দেখাশোনার সার্ভিস, বাচ্চাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার সার্ভিস, নিজের মা-বাবা এবং আত্নীয়দের দেখাশুনা করার সার্ভিস সর্বোপরি নিজের চরিত্র হেফাজতের সার্ভিসসহ সমস্ত প্রয়োজনীয় সার্ভিস পেয়ে যাচ্ছে।এই এতোকিছুর পরও আর কী চাই?
একজন স্বামীর এতোকিছু পাওয়ার পর যেখানে তার স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কথা ছিল, তাদের প্রতি তার আরো সম্মান বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে ইফতারী চেয়ে, ঈদের শপিং এর খরচ চেয়ে ইত্যাদি চেয়ে তার শ্বশুর শাশুড়ীর প্রতি কি অন্যায় করা হচ্ছে না? যুলুম করা হচ্ছে না? এছাড়া, স্ত্রীর কাছ থেকে এতো এতো সার্ভিস পাওয়ার পরও কীভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে? একজন স্বামী চরম অকৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য তার স্ত্রী এবং শ্বশুর শাশুড়ীর প্রতি এমন ঘৃণিত আচরণই কি যথেষ্ট নয়?
যে মা-বাবা লালন পালনের পর তাদের আস্তো মেয়েটাই তোর হাতে তুলে দিলেন। তাদের কাছে তোর আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? তাদের কাছে চাওয়াতে কি তোর লজ্জা হওয়া উচিত নয়? এতে কি তোর আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগার কথা নয়? তার চাইতে বড়ো নির্লজ্জ, বড়ো আত্নমর্যাদাহীন আর কে হতে পারে যে তার স্ত্রীকে চাপ দিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে এটা সেটা আদায়ের চেষ্টা করে? নিজের আত্মসম্মানবোধ-ই যদি নাই-বা থাকলো তবে সমাজের মানুষের নিকট সম্মানী লোকের ভাব ধরে কী লাভ?
আরে, শ্বশুর-শাশুরির কাছ থেকে কিছু না নিয়ে পারলে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তাদেরকে সারাজীবন আরও দিয়ে যাওয়া উচিত। যেখানে তাদের ঋণ কোনোদিনই শোধ হওয়ার নয় সেখানে একজন জামাই কীভাবে তাদের কাছে বড়ো বেহায়ার মতো এটা সেটা চাইতে পারে? কিভাবে এতোটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে? একজন মানুষ কতটুকু হীন মানসিকতার হতে পারে তা বোঝার জন্য তার এমন আচরণই যথেষ্ট। আমার ঐ দৃষ্টান্তের বিষয়টি যদি তুই বুঝতে পারিস তবে এই বিষয়টা কেনো বুঝতে পারিস না?
আর একবারও কি তোর ভেবে দেখা হয়েছে যে, আজ যদি তুই নিজে শ্বশুরের ভূমিকায় থাকতি এবং তোর মেয়ের জামাই যদি তোর কাছে এটা সেটা চেয়ে বসতো তবে তোর কেমন লাগতো? তখন বুঝি উদারমনা হয়ে মেয়ের জামাইকে হাসিমুখে সবকিছু উজার করে দিয়ে দেওয়া হতো?
প্লিজ আমাকে আর লজ্জা দিস না বন্ধু। আসলে, তুই যেভাবে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিস তাতে আমার মাথা নিচু হয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ এগুলোর কোনো জবাব আমার কাছে তো নেই-ই এমনকি দুনিয়ার কোনো স্বামীর কাছেও থাকার কথা নয়।
আর তুই যেভাবে কথাগুলো বলেছিস সেভাবে কখনো ভেবে দেখি নি বিধায় না বুঝেই নিজের স্ত্রীর ওপর, নিজের শ্বশুর শাশুড়িদের ওপর বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি, বড়ো যুলুৃম করে ফেলেছি।
আসলে সত্যিই তো, যে মেয়েকে তার মা বাবারা জন্ম থেকে শুরু করে সমস্ত খরচ বহন করে বড়ো করে তুলতে না তুলতেই স্বামী অর্থাৎ আমার হাতে তুলে দিলেন সেই মেয়ে তো আমার কাছে বেশিই আদর-যত্ন পাওয়ার দাবি রাখে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, সেই মেয়ের মা বাবারা অর্থাৎ আমার শ্বশুর-শাশুড়ীরা তাদের মেয়েকে লালন পালন করে আমার সেবার উপযোগী করার জন্য তারা আমার নিকট আরো বেশি ভালোবাসা পাওয়ার দাবি রাখেন, সম্মান পাওয়ার দাবি রাখেন। আর সেই জায়গায় কি-না আমি তাদের নিকট এটা সেটা চেয়ে তাদেরকে মানসিক নির্যাতন করে চলছি, আর্থিক কষ্টে ফেলছি, অপমান করে চলছি। আসলে এমন উপলব্ধি আগে কখনো হয়নি তো, তাই বুঝতে পারি নি। আজ তোর কথাগুলো শুনে এমন উপলব্ধি হচ্ছে। সত্যিই, তোর দৃষ্টান্ত আমার অন্তর্চক্ষু খোলে দিয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ! তুই তো বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিস। আর এতেই বোঝা যাচ্ছে, তোর আত্মসম্মানবোধ এখনো ফুরিয়ে যায় নি, তুই এখনো নিলর্জ্জদের কাতারে চলে যাস নি। আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ সমাজের অনেক ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের মানুষ আছে যারা এগুলো অনুধাবনই করতে পারে না যেনো তাদের অন্তর ভালো মন্দের উপলব্ধি হারিয়ে মৃত অন্তরে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তারা বুঝতেই চায় না যে, তারা অন্যের হক নষ্ট করার মাধ্যমে কতোটা ভয়ানক কবিরা গোনাহ করে চলছে।
সত্যি কথা বলতে কি! আমরা সমাজের যারা এসব করি কিংবা এসব করার মনমানসিকতা লালন করি তাদের নূন্যতম লজ্জা থাকা উচিত। একজন মানুষ কতোটুকু নিচ ও ইতর প্রকৃতির হলে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে এটা সেটা পাওয়ার আশায় বসে থাকে- তা কি ভাবা যায়?
ঠিকই বলেছিস, বন্ধু। এটা বড়ো আত্নমর্যাদার বিষয়। আজ আমার অন্তর্চক্ষু খুলে দেওয়ার জন্য তোর প্রতি আমার অনেক কৃতজ্ঞতা রইলো। সত্যিই আমার স্ত্রী এবং শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে অমন আচরণের জন্য আমি বড্ড বেশি অনুতপ্ত এবং লজ্জিত।
দোয়া করি, মহান রাব্বুল আলামিন দুনিয়ার সব স্বামীকে যেনো তোর মতো বিষয়টি বোঝার তাওফিক দান করেন।
আমিন!
নাহিদ! আজকে বাসায় গিয়ে তোর স্ত্রীকে একটি সারপ্রাইজ দিতে পারিস। জানিস সেটা কী?
কী সারপ্রাইজ বল তো শুনি।
সেটা হচ্ছে, তোর স্ত্রীকে হাসিমুখে গিয়ে বলবি, দেখো! এবার কিন্তু আমার শ্বশুরকে সাফ বলে দিতে হবে যে, তারা যেনো আমাদের বাসায় ইফতারী নিয়ে আসার জন্য কোনো পেরেশানি না করেন। এসবের কোনো দরকার নেই। সেই সাথে এটাও বলতে পারিস যে, চলো! আমরা একদিন আমার শ্বশুর বাড়িতে তাদের জন্য কিছু ইফতার সামগ্রী নিয়ে তাদেরকে দেখে আসি। বিশ্বাস কর বন্ধু, এভাবে বললে তোর স্ত্রী তোর উপর অনেক খুশি হবে। তখন তার মাথা থেকে তার বাবার বাড়ি থেকে ইফতারী আনানোর মহা টেনশন দূর হবে। সে যে কি খুশি হবে তা একবার করেই দেখ না। আর এমন দৃশ্য দেখে আল্লাহও খুশি হবেন।
দ্যাটস ট্রুলি অ্যা গুড আইডিয়া, তাহসিন।
সত্যিই খুব ভালো লাগলো। এবার আমি আমার স্ত্রীকে এমন একটি সারপ্রাইজ দিতে মিস করবো না কিন্তু। এতোদিন তাকে আমি উঠতে বসতে শুধু শুধু কড়া মেজাজ দেখিয়েছি। অথচ সে বেচারি আমার জন্য কতোকিছুই না করে। আজ থেকে তার কাছে আমি অন্য এক মানবে পরিণত হওয়ায় চেষ্টা করবো। তুই বন্ধু, আমার জন্য দোয়া রাখিস। আর হ্যাঁ, তোর উপকার কখনোই ভুলার নয়।
মা শা আল্লাহ! আল্লাহ কবুল করুন।
The post যৌতুক নিয়ে বন্ধুর নসীহাহ appeared first on Trickbd.com.
0 মন্তব্যসমূহ